জীবন আহমেদ যা দেখেছেনঃ হাত-পা, শরীরের অংশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে’


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : জুন ৬, ২০২২, ৭:১২ পূর্বাহ্ণ /
জীবন আহমেদ যা দেখেছেনঃ হাত-পা, শরীরের অংশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে’

দ্রুত শেয়ার করুন-

জীবনে এত বীভৎস দৃশ্য আগে কখনো দেখিনি। যত সামনের দিকে এগুচ্ছি দেখি মানুষের হাত-পা, শরীরের অংশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আগুনে পুড়ছে মৃতদেহ, কেউ এগিয়ে যাচ্ছেন না। এত লাশও কখনো দেখিনি একসঙ্গে। সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডির স্পট থেকে মোবাইল ফোনে এভাবেই বর্ণনা দিচ্ছিলেন মানবজমিনের ফটো সাংবাদিক জীবন আহমেদ। কী দেখেছেন তিনি। জানা যাক তার জবানিতেই-

ঢাকা থেকে রাত আড়াইটায় রওনা দিয়ে সীতাকুণ্ড পৌঁছাই ভোর সাড়ে ছয়টার দিকে। গিয়েই দেখি, একটা এম্বুলেন্স দাঁড়ানো। একজন ফায়ার সার্ভিসকর্মী লাশ নিয়ে বসে আছেন। সম্ভবত তার কোনো সহকর্মীর লাশ হবে।

ছবি তুলে ভেতরে গেলাম। ভেতরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনটা বিস্ফোরণের শব্দ শুনি। ভয়ে পিছু হটি। কয়েকটা ছবি তুলে আরেক দিকে যাই। এসব দৃশ্য বর্ণনা দেয়ার মতো না। পায়ের নিচে রক্ত আর কেমিক্যালে মাখামাখি। ইতিমধ্যে বিস্ফোরণ ছড়িয়ে পড়েছে আড়াই বর্গকিলোমিটারেরও বেশি এলাকাজুড়ে। হেঁটে একপাশ থেকে অপর পাশে যেতে বেশ সময় লাগছিল। ভয়ে ভয়ে ধীর পা ফেলে এগিয়ে যাই।

অনেক জায়গায় পড়ে রয়েছে কেমিক্যাল। প্রথমে বুঝতে পারিনি। কেমিক্যাল পায়ে লাগতেই আগুন ধরে যায়। দ্রুতই আগুন নেভাতে সক্ষম হই। বুঝলাম, এই কেমিক্যাল কারও শরীরে লাগলে গলে যাবে। আরও ভেতরে গেলাম, যেখানে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা প্রাণ দিয়েছেন। ডানে তাকিয়ে দেখি টিনের ছাউনিতে কারও হাত, কারও পা, শরীরের অংশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এটা দেখার পর ভয় পেয়ে গেলাম।

কিছু সময় পরপরই বিস্ফোরণ ঘটছিল। মনে হচ্ছিল কন্টেইনারগুলো ফেটে বের হয়ে আসছে। ভেতরে ট্রাক দেখা গেল ৮/১০টা। ট্রাকগুলো জ্বলছে আর টায়ার ব্লাস্ট হচ্ছে। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা কাহিল হয়ে পড়েছেন। পানিও শেষ। আরও ভেতরে গেলাম। সম্ভবত এক যুবক তার সহকর্মীর লাশ আনার চেষ্টা করছিলেন। তিনি বারবার চেষ্টা করছিলেন লাশটা আনার। তখনো লাশটা জ্বলছিলো।

আমি বললাম, ওদিকে যাবেন না, গেলে ব্লাস্ট হয়ে যেতে পারে। কিন্তু তিনি যাবেনই। তখন তিনি বলেন, আমার সঙ্গে শুধু একজন আসেন, আমি লাশটা নিয়ে চলে আসবো। লাশটা দেখে হতভম্ব হয়ে গেলাম। লাশের পা-সহ একপাশ নাই। পুরো শরীর চেনার মতো অবস্থা নাই। কিন্তু তিনি শনাক্ত করেছেন, এটা তারই সহকর্মী। বিস্ফোরণ এলাকায় আবার ফিরে আসি। এরপর আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। কয়েকজন উদ্ধারকর্মী লাশ খুঁজতে গেলেন। তাদের সঙ্গে আমিও গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখি অনেক লাশ পড়ে আছে। আনুমানিক ১৫/১৬টি।

সম্ভবত ফায়ার সার্ভিস কর্মীদেরও লাশ ছিল। পরিবেশ দেখে মনে হচ্ছিল ভেতরে হয়তো আরও লাশ আছে। বিস্ফোরণ তো থেমে থেমে হচ্ছিলো। হঠাৎ ফের একটা বিকট বিস্ফোরণ হয়। আমরা কয়েকজন ছিলাম। আমরা দৌড় দিয়ে চলে আসি। ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মী বললেন, এই কেমিক্যাল খুবই বিপজ্জনক।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে গিয়ে দেখা গেল ভিন্ন এক দৃশ্য। কেউ কাউকে শনাক্ত করতে পারছেন না। তবে একটা বিষয় লক্ষণীয়, অন্যান্য দুর্ঘটনার থেকে কান্নার শব্দ এখানে অনেক কম। কারণ মনে হলো, এখানকার অধিকাংশ মানুষই বাইরের। স্বজনরা তখনো এসে পৌঁছায়নি। অনেক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা দেখেছি। লাশ দেখে আগে কখনো এতটা ভয় পাইনি। এবার লাশ দেখে ভয়ে আঁতকে উঠেছি। এত ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন, বীভৎস লাশ।

%d bloggers like this: